রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য রক্ষণে উদ্যোগহীনতা, ঝুঁকিতে ঐতিহ্য

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য রক্ষণে উদ্যোগহীনতা, ঝুঁকিতে ঐতিহ্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্যগুলো শুধু স্থাপত্য নয়, এগুলো জাতির ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বহন করে। ক্যাম্পাসজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই শিল্পকর্মগুলোতে ফুটে উঠেছে ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা। তবে যথাযথ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক ভাস্কর্যই এখন জরাজীর্ণ, মলিন ও অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে এক সময় এই গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলো হারিয়ে যেতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষদ, বিভাগ ও মুক্তমঞ্চে অবস্থিত ভাস্কর্যগুলো একসময় শিক্ষার্থীদের গৌরব ও প্রেরণার উৎস ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে রঙচটা, ভাঙাচোরা ও অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় পড়ে থাকায় এসব ভাস্কর্য তাদের নিজস্ব সৌন্দর্য ও মর্যাদা হারাতে বসেছে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী ভাস্কর্যগুলো শুধুই শিল্পকর্ম নয়, এগুলো জাতির মুক্তিযুদ্ধ ও সংগ্রামী ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। অথচ প্রশাসনের অবহেলায় এসব আজ অযত্নের শিকার। নিয়মিত রং করা, মেরামত কিংবা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে অনেক ভাস্কর্যই এখন আর চেনার উপায় নেই।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে দেশের ইতিহাস-সমৃদ্ধ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য। সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নিচে তুলে ধরা হলো:
মুক্তিযুদ্ধের স্মারক এই ভাস্কর্যটি সিনেট ভবনের দক্ষিণ চত্বরে অবস্থিত। শিল্পী নিতুন কুণ্ডুর শৈল্পিক ছোঁয়ায় এটি নির্মিত হয় লাল বেলে মাটি দিয়ে। ১৯৯১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি নির্মাণকাজ শুরু হয়। সংগ্রামী বাঙালির ইতিহাস ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার চূড়ান্ত বিজয় এই ভাস্কর্যে তুলে ধরা হয়েছে।
ভাস্কর্যের পাদদেশে রয়েছে একটি মুক্তমঞ্চ। ছয় ফুট উঁচু বেদীর ওপর নির্মিত দুটি তরুণ মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতির মাধ্যমে তরুণদের অবদানকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ভাস্কর্যের একপাশে বাউলদের একতারা বাজিয়ে গান গাওয়ার দৃশ্য রয়েছে যা গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। অন্য পাশে মায়ের কোলে শিশু, হাতে পতাকা হাতে এক তরুণী এবং তাকিয়ে থাকা এক কিশোর এসব উপাদানে ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা।
মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ হওয়া গণিত বিভাগের শিক্ষক হবিবুর রহমানের স্মরণে ২০১১ সালে এই সৌধটি নির্মিত হয়। এটি শহীদ হবিবুর রহমান হল চত্বরে অবস্থিত। ভাস্কর্যটির নির্মাতা শিল্পী শাওন সগীর সাগর।
প্রায় পাঁচ ফুট দৈর্ঘ্যের দুইজন মুক্তিযোদ্ধা দাঁড়িয়ে রয়েছেন, একজনের হাতে বন্দুক এবং অন্যজনের হাতে কলম। বন্দুকের চেয়ে কলম উঁচু স্থানে অবস্থান করছে— যার মাধ্যমে জ্ঞানের শক্তিকে তুলে ধরা হয়েছে। এটি একটি ষষ্ঠভুজ বেদির ওপর স্থাপিত, যেখানে বাংলাদেশের ইতিহাসের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা চিত্রিত করা হয়েছে। উপরে রয়েছে একটি সূর্য, যার মাঝখানে লেখা ‘বিদ্যার্ঘ’ শব্দটি জ্ঞানের আলোকে প্রতীকায়িত করে।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে স্মরণ করে নির্মিত হয় ‘স্ফুলিঙ্গ’। এটি নির্মাণ করেন মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কনক কুমার পাঠক, ২০১২ সালে।
এতে রয়েছে শহীদ শামসুজ্জোহার তিন ফুট উচ্চতার আবক্ষ ভাস্কর্য। পেছনে রয়েছে বাঁকা লম্বা একটি দেয়াল, যা লাল ও কালো ইট দিয়ে তৈরি। দেয়ালের মাঝখানে গোলাকার একটি বৃত্ত রয়েছে। পাশ থেকে দেখলে মনে হয় এটি বাংলাদেশের উড়ন্ত জাতীয় পতাকার প্রতীক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তিকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০০৩ সালে তৈরি হয় সুবর্ণ জয়ন্তী টাওয়ার। এটি প্রশাসন ভবনের সামনে, জোহা চত্বরের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে অবস্থিত।
রাজশাহীর কৃতি সন্তান, প্রখ্যাত ভাস্কর মৃণাল হকের তৈরি এই স্টিলের ভাস্কর্যটি প্রায় ৩৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট। নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ১৫ লাখ টাকা। এটি বাংলাদেশের অন্যতম আধুনিক নান্দনিক স্থাপত্য হিসেবে বিবেচিত।
শহীদ শামসুজ্জোহা হল থেকে আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই স্মৃতিস্তম্ভটি ১৯৭২ সালের ২৩ এপ্রিল আবিষ্কৃত গণকবরের স্মৃতিতে নির্মিত। এখানে ৮-১০টি গণকবর রয়েছে বলে ধারণা করা হয়, যেখানে বহু মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
স্মৃতিস্তম্ভটি সমতল ভূমি থেকে ৪২ ফুট উঁচু। এটি ছয় স্তর বিশিষ্ট এবং একটি গোলাকার কংক্রিটের বেদির মাঝে অবস্থিত ‘মৃত্যুকূপ’-এর প্রতীকী কাঠামো দিয়ে ঘেরা। স্তম্ভের গায়ে রয়েছে কালো ছাপ, যা শহীদদের রক্তের দাগকে বোঝায়। ভাঙা ইটের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরের ক্ষতকে প্রতীকায়িত করা হয়েছে।
প্রধান ফটকের পশ্চিম পাশে ‘ওয়েবসাইট ভাস্কর্য’ (ru.ac.bd); ড. মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা ও স্যার জগদীশচন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনের মাঝখানে একটি ‘কিউব’ ভাস্কর্য;
কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে ‘বইয়ের স্তূপ’ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সিনেট ভবনের সামনে ‘বই’র ভাস্কর্য; এই ভাস্কর্যগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানের প্রতীক ও সংস্কৃতির প্রতিফলন হিসেবে বিবেচিত।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. জুবায়ের হোসেন বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি আমাদের আবেগ, গৌরব এবং ইতিহাসের ধারক। ক্যাম্পাসজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রতিটি ভাস্কর্য আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস বহন করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই নিদর্শনগুলো আজ অবহেলিত, ক্ষয়প্রাপ্ত ও ভগ্নদশায় পড়ে আছে। সংস্কার না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হবে।’
চারুকলা অনুষদের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সনৎ কুমার ঢালি বলেন, ‘আমরা শ্রম দিয়ে ভাস্কর্য তৈরি করি, কিন্তু এগুলো সংরক্ষণের জন্য কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নেই। প্রশাসন যদি এগুলোর যত্ন নিত, তাহলে এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অমূল্য সম্পদ হয়ে উঠত।’
ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী হাসান বলেন, ‘প্রশাসনের অবহেলায় চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের তৈরি বহু ভাস্কর্য ক্যাম্পাসে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। এর আগেও শিক্ষার্থীরা শতাধিক ভাস্কর্য ছড়িয়ে দিয়ে প্রতিবাদ করেছিল, তবুও তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।’
নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাফসান আলম বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্যগুলো আমাদের কাছে শুধু শিল্পকর্ম নয়, এগুলো আমাদের ইতিহাস ও সংগ্রামের জীবন্ত সাক্ষী। আমরা যারা আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি, তাদের জন্য এগুলো অতীতকে জানার, অনুপ্রেরণা নেওয়ার এবং নিজেদের সাংস্কৃতিক শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রতীক। তাই ভাস্কর্যের সংস্কার শুধু মেরামত নয় বরং আমাদের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের দায়িত্বও। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, এসব ভাস্কর্যকে যত্নের সঙ্গে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে তা শুধু আমাদের চোখকে সৌন্দর্যের আনন্দই দেবে না বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ইতিহাস ও মূল্যবোধ পৌঁছে দেবে।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, আমি মনে করি, এই ভাস্কর্যগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। কারণ এগুলো আমাদের ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়। একইসাথে সামনে আমাদের কি করনীয় সেই বিষয়গুলো স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই এগুলো আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। ইতিহাস ভুলে গেলে মানুষ পথ হারিয়ে ফেলে। আমি মনে করি, শিক্ষার্থীদের চোখের সামনে এই নিদর্শনগুলো থাকা দরকার। যেন তারা অতীত স্মরণে রেখে তাদের ভবিষ্যতকে গড়তে পারে।
সংস্কারের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ইতিহাসের এই স্মৃতিস্তম্ভগুলো রক্ষণাবেক্ষনের জন্য আমরা বদ্ধপরিকর। এগুলোর সংস্কার আমরা সবসময়ই করি। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ যে ভাস্কর্যগুলোর সংস্কার প্রয়োজন সেগুলো সংস্কার করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি।
📷 ইনস্টাগ্রাম নোটিশ:
সার্ভারে জায়গা স্বল্পতার কারণে ছবি সংরক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না। ছবি পেতে আমাদের
ইনস্টাগ্রাম
ভিজিট করুন।