মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনই ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের’ জন্য দায়ী

মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনই ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের’ জন্য দায়ী

21 October, 2025 | সময়: 4:33 pm

টেকসই পরিবহন কৌশল ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব নয়— এমন মন্তব্য করে বাংলাদেশ রোড সেফটি নেটওয়ার্ক জানিয়েছে, দেশের সড়কে চলাচলকারী বিপুলসংখ্যক মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনই আজ কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ। সংগঠনটির দাবি, দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দেশে প্রতিদিন মানুষ অকারণে প্রাণ হারাচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধ না করলে এই মৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব নয়। এটি এখন আর দুর্ঘটনা নয়, বরং কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড।

মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির শফিকুল কবির মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়।

বাংলাদেশ রোড সেফটি নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক পাহাড়ী ভট্টাচার্য বলেন, স্বাধীনতার পর অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও দেশে কোনো টেকসই পরিবহন কৌশল বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে সড়ক পরিবহন খাতে আজও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। সড়ক অবকাঠামো দুর্বল, পরিবহন সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দুর্ঘটনা শুধু বাড়ছেই না, মানুষের মধ্যে অনিরাপত্তার সংস্কৃতিও তৈরি হচ্ছে।

পাহাড়ী ভট্টাচার্য বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিশন গঠন করলেও সড়ক পরিবহন খাত সংস্কারের জন্য কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি। সরকার এখনই সড়ক ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিশন গঠন করলে সড়ক খাতের নৈরাজ্য রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বর্তমানে দেশে প্রায় পাঁচ লাখ মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন রয়েছে, যার মধ্যে ৭০ শতাংশ এখনো রাস্তায় চলাচল করছে। এর মধ্যে বাস, ট্রাক ও পণ্যবাহী যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। কেবল রাজধানীতেই ১০ হাজারের বেশি পুরনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন প্রতিদিন চলাচল করছে। সংগঠনটির ভাষায়, এসব যানবাহনের কারণে প্রতিদিন সড়কে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, অথচ এটি থামানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। এই মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি একটি সংগঠিত কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। তারা সড়ক থেকে দ্রুত মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন প্রত্যাহারের দাবি জানান। পাশাপাশি নতুন যানবাহন ক্রয়ের জন্য মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের নীতিমালা প্রণয়নের আহ্বান জানানো হয়।

বক্তারা বলেন, গণপরিবহন খাতে রাজনৈতিক প্রভাব ও চাঁদাবাজির কারণে নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। রাজনীতির ছায়া সরাতে না পারলে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে না। এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির মাধ্যমে গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রেখেছে। তারা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত গণপরিবহন ব্যবস্থা গঠনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

গণপরিবহন চালকদের জন্য নিয়োগপত্র, নির্দিষ্ট বেতন, কর্মঘণ্টা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিতের ওপরও জোর দেওয়া হয়। বক্তাদের মতে, সড়ক নিরাপত্তা কেবল আইন দিয়ে নয়, পেশাগত মর্যাদা নিশ্চিত করেও অর্জন করা সম্ভব।

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেন বক্তারা। এজন্য ইন্টিগ্রেটেড ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম, রোড ট্রাফিক সেফটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ও সার্ভিল্যান্স ক্যামেরা বাধ্যতামূলকভাবে চালুর দাবি জানানো হয়। তারা বলেন, এসব প্রযুক্তি ব্যবস্থার মাধ্যমে গাড়ির গতি, চালকের আচরণ ও রাস্তায় শৃঙ্খলা একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

রাজধানীর গণপরিবহন শৃঙ্খলায় আনতে রুট রেশনালাইজেশনের মাধ্যমে কোম্পানিভিত্তিক বাস সার্ভিস চালুর প্রস্তাব দেওয়া হয়। বক্তারা বলেন, মাত্র সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকায় চার হাজার নতুন বাস কিনে কোম্পানিভিত্তিক পরিচালনা করলে চাঁদাবাজি, বাস দৌড় এবং বিশৃঙ্খলা বন্ধ হবে। নগরবাসী সম্মানজনকভাবে ও সাশ্রয়ী মূল্যে যাতায়াত করতে পারবেন।

রাজধানীর স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য নিজস্ব বাস সার্ভিস চালু বাধ্যতামূলক করার দাবি জানানো হয়। এতে যানজট কমবে এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে বলে মত দেন বক্তারা। প্রয়োজনে বাস কিনতে আমদানি শুল্ক হ্রাস ও ঋণ সুবিধা প্রদানের আহ্বান জানানো হয়।

বক্তারা বলেন, নগর গণপরিবহন কোনোভাবেই নারীবান্ধব নয়। নারী যাত্রীদের নিরাপত্তা ও সম্মানের জন্য বাসের নকশা পরিবর্তন, দরজা বাসের মধ্যভাগে স্থাপন এবং সিট পরিষ্কার রাখার আহ্বান জানানো হয়। তাছাড়া প্রতিবন্ধী যাত্রীদের কথা মাথায় রেখে র‍্যাম্পযুক্ত বাস আমদানি, চালক প্রশিক্ষণে প্রতিবন্ধী সচেতনতা অন্তর্ভুক্তি ও পরিবহন পরিকল্পনায় প্রতিবন্ধী সংগঠনকে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

বক্তারা জানান, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। চার চাকার গাড়ির তুলনায় মোটরসাইকেল ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই মোটরসাইকেলের গতি নিয়ন্ত্রণ, মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালনা বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগের দাবি জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিদ্যমান জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এই কাউন্সিল পুনর্গঠনের দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি বিআরটিএ, বিআরটিসি ও ডিটিসিএতে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পরিবর্তে টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞ নিয়োগের দাবি তোলা হয়। বক্তারা বলেন, টেকনিক্যাল জ্ঞানসম্পন্ন নেতৃত্ব না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান কাঠামোগত ত্রুটি কাটিয়ে উঠতে পারছে না।

সংগঠনটি সড়ক, রেল ও নৌপরিবহনকে একীভূত করে অভিন্ন যোগাযোগ মন্ত্রণালয় গঠনের প্রস্তাব দেয়। তাদের মতে, সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হলে পণ্য পরিবহনের খরচ কমবে, সড়কে চাপ হ্রাস পাবে এবং দুর্ঘটনাও কমবে।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত-আহতদের আর্থিক সহযোগিতার জন্য গঠিত ট্রাস্ট ফান্ডে প্রতি বছর অন্তত ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দের দাবি জানানো হয়। বক্তারা বলেন, রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটছে— তাই ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।

বিসিএস ক্যাডারের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও রিফ্রেশার কোর্সে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ মডিউল অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এতে প্রশাসনের কর্মকর্তারা সড়ক ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে মত দেন বক্তারা।

পাহাড়ী ভট্টাচার্য বলেন, আমরা বিশ্বাস করি আধুনিক নীতিমালা, প্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে টেকসই সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। এখনই সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার যদি পদক্ষেপ নেয়, তাহলে সড়ক হবে নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও জনবান্ধব।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (নিসআ)-এর সভাপতি আব্দুল্লাহ মেহেদী দীপ্ত, বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান)-এর নির্বাহী পরিচালক সালমা মাহবুব, ইভেন্টফুল বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক মো. রোকন উজ্জামান, নুসরাত জাহান তমা ফাউন্ডেশনের কোষাধ্যক্ষ শারমিন ইসলাম, সেবা বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ইয়াসমিন আরা, বাংলাদেশ রোড সেফটি নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক পাহাড়ী ভট্টাচার্য, থটস অ্যান্ড থরো-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. তৌফিকুজ্জামান এবং সেন্টার ফর ওয়ার্ক অ্যান্ড অক্যুপেশনাল হেলথ সেফটির প্রধান সমন্বয়ক মো. সেলিম প্রমুখ।

📷 ইনস্টাগ্রাম নোটিশ:
সার্ভারে জায়গা স্বল্পতার কারণে ছবি সংরক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না। ছবি পেতে আমাদের ইনস্টাগ্রাম ভিজিট করুন।